অগ্রক্রয় বা প্রিয়েমশন কি কত দিনের মধ্যে এর মামলা করতে হয়
আসসালামু আলাইকুম! সম্মানিত পাঠক বৃন্দ, আশা করছি সুস্থ থেকে নিজ কাজে ব্যস্ত রয়েছেন। এরই ফাঁকে আপনি জানার আগ্রহ প্রকাশ করছেন অগ্রক্রয় সম্পর্কে, আজ আমরা এই আর্টিকেল এর মাধ্যমে আপনাকে জানাচ্ছি অগ্রক্রয় বা প্রিয়েমশন কি এবং এর মামলা কত দিনের মধ্যে করতে হয়। উক্ত বিষয়টি আপনাকে পরিপূর্ণভাবে জানতে হলে আমাদের এই আর্টিকেলটি শেষ পর্যন্ত পড়ুন।
অগ্রক্রয় বা প্রিয়েমশন একটি ভূমি মালিকদের জন্য অধিকারো বটে। এই এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যপূর্ণ বিষয়ে যে, আপনার একটু ভুলের কারণে ঘটে যেতে পারে বড় ধরনের দুর্ঘটনা। অতএব আপনি যেকোনো জমি ক্রয় করার পূর্বে উক্ত জমিটির সকল ধরনের সমূহ বিপদসম্ভব না দেখে শুনে যাচাই করে আপনি জমি ক্রয় করুন। নচেৎ আপনাকে ভুগতে হতে পারে বিভিন্ন ধরনের আইনি জটিলতা।
ভূমিকা
আজ আমরা যে বিষয়টি নিয়ে আলোকপাত করছি বিষয়টি অনেক গুরুত্বপূর্ণ ও সেনসিটিভ। আপনি যদি জমি ক্রেতা হন, অথবা জমির বিক্রেতা, ওয়ারিস, ভাগীদার, বা পড়শি হয়ে থাকেন তাহলে অগ্রক্রয় বিষয়ে আপনার একটি স্পষ্ট ধারণা থাকা জরুরি বলে আমি মনে করছি। কারণ আপনার একটি অবিচক্ষনতা কিংবা অসতর্কতার ফলে ঘটে যেতে পারে নানা ধরনের আইনে জটিলতা।
অগ্রক্রয় বা প্রিয়েমশন কি
অগ্রক্রয় এমন একটি অধিকার যা ভূমি মালিক লিগ্যাল ওয়েতে তার নিজভূমি বিক্রয় করার পরেও এমন কিছু ব্যক্তি আছে যারা উক্ত জমি পাওয়ার অধিকার রাখে। মুসলিম আইনে যা হক শূফা নামে পরিচিত এবং ইংরেজীতে যা রাইট অব প্রিয়েমশন। এ ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলমানদের কর্তৃক এ আইনটি সর্বপ্রথম প্রবর্তন হয়।
পরবর্তীতে ব্রিটিশ আমলেও চলমান ছিল যা এখন পর্যন্ত চলমান। মুসলিম ধর্মাবলম্বীরা তাদের হক সবার মধ্যে অন্য কোন জাতিগোষ্ঠী বা ব্যক্তি যেন এসে তাদের শান্তি এবং বসবাসের মধ্যে বিঘ্ন সৃষ্টি করতে না পারে এজন্য তৎকালীন সময়ে এই আইন প্রচলন করা হয়। যা বর্তমানে মুসলিম পারিবারিক আইন এর মাধ্যমে আজও চলমান।
অগ্রক্রয়ের বা প্রিয়েমশন উদ্দেশ্য
এর উদ্দেশ্য মূলত কোনো জোত জায়গা বা ভূমি, যাতে করে অন্য কোন ওয়ারিশ গন দের মধ্যে বা উক্ত জোত জায়গা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশে বিভক্ত না হয়ে, নিজ হক সবার মধ্যে রয়ে যায় এবং উক্ত স্থানে বহিরাগত যেন আসতে না পারে আর উক্ত পরিবেশের বিঘ্ন সৃষ্টি হওয়ার কারণ না হয়। এজন্য অগ্রক্রয় বা প্রিয়েমশন এর সিস্টেম বা আইন প্রচলিত আছে।
বিষয়টি আরেকটু ক্লিয়ার করি! মনে করুন, আপনি একটি ভূমির মালিক। উক্ত ভূমি একটি দাগে আরও আপনার অন্য ওয়ারিশগণের সম্পত্তি রয়েছে বা উক্ত খতিয়ানে আপনার আরও অংশীদার রয়েছে। এখন কোন ওয়ারিশ বা বাকি অংশীদার আপনার ওই ভূমির পাশেই তাদের অংশটুকু অন্য আরেকজন বহিরাগত ব্যক্তির নিকট জমি হস্তান্তর করেছে।
আরো পড়ুনঃ পত্রিক সম্পত্তি নামজারি করার নিয়ম
আপনি এটি বুঝতে পেরেছেন এবং উক্ত জমি আপনি ক্রয় করতে চাচ্ছেন। এখন আপনি যেটি করতে পারেন সেটি হচ্ছে অগ্রক্রয়। অর্থাৎ উক্ত জমি আপনার বাকি অংশীদার বা ওয়ারিশ আপনাকে না জানিয়েই অন্যত্রে বিক্রয় করেছে।
এখন আপনি উক্ত জমিটি ফেরত নিতে চাচ্ছেন সেক্ষেত্রে আপনাকে উক্ত জমিটির ক্রেতার দলিলে উল্লেখিত মূল্য পরিশোধ করে এবং সংশ্লিষ্ট কিছু খরচ প্রদান করে উক্ত জমিটি আপনি আপনার নিজ নামে নিয়ে আসতে পারেন। আর এই নিয়ে আসার পুরো সিস্টেমটাকে অগ্রক্রয় হিসেবে গণ্য করা হয়।
অগ্রক্রয় মামলার ধরন সমূহ
কৃষি এবং অকৃষি উভয় ধরণের সম্পত্তির ক্ষেত্রেই অগ্রক্রয়ের অধিকার দাবি করে মামলা করার সুযোগ রয়েছে। বর্তমানে আমাদের দেশে ৪ ধরনের অগ্রক্রয় মামলা হয়ে থাকে। নিচে বিষয়গুলো নিয়ে আপনাকে জানানো হলো-
- মুসলিম আইনের অধিন অগ্রক্রয় মামলা।
- কৃষি জমির ক্ষেত্রে- রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহন এবং প্রজাস্বত্ব আইন (সংশোধন ২০০৬) ১৯৫০ এর ৯৬ ধারা
- অনুসারে অগ্রক্রয় মামলা।
- অকৃষি জমির ক্ষেত্রে- অকৃষি প্রজাস্বত্ব আইন ১৯৪৯ এর ২৬ ধারায় অগ্রক্রয় মামলা ।
- বন্টন আইনের ৪ ধারায় অভিভক্ত বাড়ীর সম্পত্তির ক্ষেত্রে অগ্রক্রয় মামলা।
কারা অগ্রক্রয়ের মামলার অধিকার রাখে
অগ্রক্রয় মামলা করার অধিকার যারা রাখে তারা হচ্ছে উক্ত ভুমিটি বিক্রয় বা হস্তান্তর করার পরেও যে সকল ব্যক্তিবর্গ উক্ত জমিটি নিজ নামে ফিরিয়ে আনার জন্য আবেদন করে যে মামলা রুজু করে সেই সকল ব্যক্তির অধিকার উক্ত জমিতে থাকে তার নিচে আপনাকে জানিয়ে দেওয়া হচ্ছে-
- বিক্রয়কৃত বা হস্তান্তরকৃত জমিটির দাগে বা খতিয়ান এ থাকা অন্য প্রজা।
- বিক্রয় কৃত বা হস্তান্তরকৃত জমিটির অন্য ওয়ারিশগণ উক্ত জমিটি পাওয়ার অধিকার রাখে।
- বিক্রয় কৃত বা হস্তান্তরকৃত জমিটির পার্শ্ববর্তী দাগের প্রজাগন উক্ত জমিটি পাওয়ার অধিকার রাখে।
অগ্রক্রয়ের মামলা কখন করা হয়
কোন জমি বা ভূমি বিক্রয় বা হস্তান্তর করার পর যদি উক্ত দাগে থাকা অন্য কোন প্রজা বা উক্ত জমির ওয়ারিশগণ কিংবা উক্ত জমিটির পার্শ্ববর্তী দাগের প্রজাগন উক্ত জমি তাদের নামে রাখতে ইচ্ছা প্রকাশ করে। এমত অবস্থায় অগ্রক্রয় বা প্রিয়েমশন এর মামলা করা হয়। আপনাকে যদি বিষয়টি আরো ক্লিয়ার করে বলি তাহলে বিষয়টি এরকম হবে-
মনে করুন আপনি আপনার পৈতৃক সম্পত্তি কিংবা আপনার নিজ ক্রয় সম্পত্তি যেই দাগে বা স্থানে অবস্থান করছে উক্ত স্থানের অন্য কোন প্রজা বা ওয়ারিশগণ কোন জমি বিক্রয় করতে চাচ্ছে, উক্ত জমিটি আপনি ক্রয় করতে চাচ্ছেন কিন্তু আপনাকে তো বিক্রেতা জমিটি দিতে ইচ্ছুক নয়।
কিংবা বিষয়টি এমনও হতে পারে আপনার ক্রয়ের অধিকার সম্পত্তিটি আপনার অজান্তেই বিক্রয় হয়েছে এমত অবস্থায় আপনি জানতে পারছেন উক্ত জমিটি বিক্রয় হয়েছে এখন আপনি উক্ত জমিটি পুনরায় আপনার নিজ নামে নিতে চাচ্ছেন এমত অবস্থায় যে কাজটি আপনার করণীয় সেটাই হচ্ছে অগ্রক্রয় বা প্রিয়েমশন।
কত দিনের মধ্যে অগ্রক্রয় বা প্রিয়েমশন এর মামলা করতে হয়
অগ্রক্রয় বা প্রিয়েমশন এর অধিকার সম্পত্তিটি বিক্রয় হওয়ার বা বিক্রয় দলিল হওয়ার পর হতে সর্বোচ্চ তিন বছর এর মধ্যে আপনাকে যথাযথ আদালতে অর্থাৎ দেওয়ানি আদালতে বিষয়টি জানিয়ে আপনাকে আবেদন অর্থাৎ মামলা করতে হবে। তিন বছর পর উক্ত বিষয়ে আর মামলা করা যাবে না। অতএব আমরা বলতে পারি অগ্রক্রয়ের মামলার সময় তিন বছর।
অগ্রক্রয়ের মামলার জন্য কত টাকা প্রয়োজন
রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ এবং প্রজাস্বত্ব আইন (সংশোধন ২০০৬) ১৯৫০ এর ৯৬(৩) ধারা অনুসারে অগ্রক্রয় বা প্রিয়েমশন মামলা করতে হলে আপনাকে যে সকল টাকা পয়সার প্রয়োজন হবে তা নিম্নরূপ-
দলিলে উল্লেখিত মোট মূল্যের টাকা পরিশোধ করতে হয়।
দলিলে উল্লেখিত মোট মূল্যের উপর শতকরা ২৫ পার্সেন্ট হারে জরিমানা প্রদান করতে হয়।
দলিলে উল্লেখিত মোট মূল্যের উপর শতকরা ৮% হারে সুদ প্রদান করতে হয়।
অগ্রক্রয়ের বা প্রিয়েমশন মামলা কখন করা যাবে না
সকল বস্ত্রই একটি সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া রয়েছে। যেমুন অগ্রক্রয় এর ব্যবস্থা রাখা হয়েছে ঠিক তেমনি অগ্রক্রয় করতে পারবেন না এরকমেরও ব্যবস্থা রয়েছে। চলুন তাহলে দেখে নেই কোন ক্ষেত্রে অগ্রক্রয়ের মামলা করা যাবে না-
- আপনার যদি অগ্রক্রয়ের অধিকার ক্ষুন্ন হয় অর্থাৎ আপনি অগ্রক্রয়ের অধিকার হারান।
- অগ্রক্রয়ের মামলা করতে যদি তামাদির সময়ে অবতীর্ণ হন। অর্থাৎ নির্দিষ্ট মেয়াদের পরে এই মামলা আর করা যাবে না।
- জমির বিক্রেতা বা হস্তান্তর দাতা পুনরায় যদি তার নিজ নামে জমিটি ফেরত নিয়ে নেই, সেক্ষেত্রে আপনি অগ্রক্রয়ের মামলা করতে পারবেন না।
উপসংহার
কোন জমি বা ভূমি বিক্রয় বা হস্তান্তর করার পর তখনই আপনি অগ্রক্রয়ের মামলা করতে পারবেন যখন আপনি অগ্রক্রয়ের শর্ত সমূহের মধ্যে পড়বেন অর্থাৎ অগ্রক্রয়ের মামলা করতে হলে আপনাকে বিকৃত জমিটির দাগের প্রজা হতে হবে, ওয়ারিশ হতে হবে, খতিয়ানের অংশীদার হতে হবে, সর্বশেষ পার্শ্ববর্তী দাগের মালিক হতে হবে।
লেখক এর কথা
আপনি যে জমিটি ক্রয় করতে চাচ্ছেন বা আপনি কি জমি বিক্রি করতে চাচ্ছেন তাহলে আপনার উচিত হবে আপনার অংশীদারদেরকে প্রথমে জানানো যদি তারা কিনতে সক্ষম হয় তাহলে তাদের কাছে বিক্রি করুন অথবা তাদের ক্রয় করার ইচ্ছা বা ক্ষমতা না থাকলে অন্যত্রে বিক্রি করুন। অযথা ঝামেলায় জড়াবেন না অর্থ-শ্রম-ভোগান্তির ভাগীদার হবেন না।
পরিশেষে বলতে চায় আমাদের এই আর্টিকেলটি যদি আপনার ভালো লেগে থাকে তাহলে আপনার পরিচিত জনদের মাঝে শেয়ার করে দেন যাতে করে তারাও বিষয়টি উপলব্ধি করতে পারে এবং সতর্ক থাকতে পারে।
আমাদের এই পোস্টটি শেষ পর্যন্ত পড়ার জন্য আমাদের পক্ষ থেকে আপনাকে জানাই আন্তরিক ধন্যবাদ
অনেক ভালো একটি তথ্য, সকলের উপকারে আসবে।